আজ আমি কিছু লিখবো না। যা শুনেছি তা বলবো। আজকের লেখাটাকে শ্রুতলিপি বলাই ভালো। শ্রুতলিপি কি? তা আজকালের অনেক শিক্ষার্থীই জানে না। আমরা যখন প্রাথমিক শিক্ষা লাভের জন্য কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়তাম। তখন, চয়নিকা বই থেকে শিক্ষক পড়তেন। আমরা ছাত্রছাত্রীরা তা শুনে শুনে লিখতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস স্যার বললেন, চলো, আজ তোমাকে আমি, আমার প্রিয় জামালি স্যারের বাসায় নিয়ে যাবো।
(এটা আমার সৌভাগ্য বটে) জামালি স্যারের বাসায় বিছানায় বসে রোবায়েত স্যার বলছিলেন, আমি যখন হাইস্কুলে পড়ি তখন, এই জামালি স্যার আমাকে টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলতেন, আজ “মুক্তি” (অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের উপনাম “মুক্তি”) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কথা বলবে, শেরে বাংলা নিয়ে কথা বলবে, নজরুল ইসলামকে নিয়ে বলবে। এভাবেই একদিন আমি বক্তা হই। বিতার্কিক হয়ে যাই। একসময় বিতর্ক অনুষ্ঠানের বিচারকের আসনেও বসি। দ্রুত কথা শেষ করেই বললেন, স্যার, আজ আবার শুধু আপনার কাছ থেকেই সব শুনবো।
আমার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে, বললেন, স্যার, আপনি শেখ ফরিদকে গরুর মিটিং এর গল্পটা শোনান প্রথমে। জামালি স্যার, সরিষাবাড়ি রামনগর আরইউটি হাই স্কুলের ক্লাসে ছাত্রদের গল্পটা শোনাতেন। আমি তখন শিমলাবাজারে আরডিএম পাইলট হাইস্কুলে পড়তাম। তবে, আমিও জামালি স্যারকে চিনতাম। এবং তার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনতাম, আমার হাইস্কুল শিক্ষকদের কাছ থেকে।
জামালি স্যার, গল্প শুরু করলেন, সাধারণত আমরা ছাত্রদের পেটানোর আগে বলতাম, এই গরু, পড়া শিখে আসস নাই কেন? তো, স্কুলে স্কুলে ছাত্রদের এভাবে “গরু’ সম্বোধন করে মানুষের বাচ্চাদের পেটানোর খবর গরু সমাজে রটে গেল। গরুদের ভেতর কানাঘুষা শুরু হলো। একদল গরু সেই ক্ষোভে সভা আহ্বান করলো। সকল গরু একদিন মস্ত বড় এক বটবৃক্ষের নিচে সভায় বসলো। বৃদ্ধ একটি গরু সভা পরিচালনা করছিলো। কার কি কি অভিযোগ তা জানতে চাইলো।
অনেক গরু বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নয়। বিশেষ করে বন্য গরু, তারা তো আর গৃহপালিত ছিল না। তারা স্কুল, শিক্ষক, ছাত্র শব্দগুলো সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞাত। কারন, তারা বনে ঘুরে বেড়ায় ঘাস খায়। কম বয়সী গরুদের মুখে এসব কথা শুনে বন্য গরুরা বেশি ক্ষিপ্ত হলো। বন্য বলে কথা, ক্ষিপ্ত তো হবেই। এরা মাঝে মাঝে থাবা যুক্ত চার পেয়ে বনের রাজা-বাদশা, বাঘ -সিংহকেই গুতো মেরে বসে। আর তো দু পেয়ে মানুষ! তাই, এভাবে গরু অবমাননা তারা মেনে নিতে পারছে না। কেউ, গরু বলে কাউকে উপহাস করবে। আবার গরুর নাম ধরে পেটাবে এটা অসহ্য!
আজ তারা মানুষের সাথে এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে। মানুষের বাচ্চা মানুষকে পেটালে যদি মানুষ কোন সমস্যা মনে না করে। তবে তাদের সমস্যা নেই। কিন্তু গরু নামে পেটালে তারা যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। কেন না, মানুষের বাচ্চাকে গরু বলে বলে পেটানোর সময় গরু শব্দটি বোকার হদ্দ, অযোগ্য অর্থ বুঝায়। গরুরা বোকা নয় অযোগ্য নয়। আমরা তা, মানবো না। গরু সভায় হাম্বাহাম্বা রব উঠে গেল। বয়স্ক গরুরা কোন রকমে উত্তেজিত গরুসভা শান্ত করলো।
এবার ফয়সলা দেওয়ার জন্য তাদের বৃদ্ধ নেতা দাঁড়ালো এবং প্রথমেই বললো, সভায় উপস্থিত বন্ধুরা শুনুন, আমরা গরুরা কোন অবস্থাতেই মানুষের চেয়ে ছোট নই। আমাদের নামে কেউ কাউকে উপহাস করবে। অথবা আমাদের গরু সমাজের নাম নিয়ে কেউ কাউকে পেটাবে, তাও মেনে নেবো না৷ তবে আপনারা গরুদের এতে এত ক্ষুব্ধ হওয়ার কিছু নেই। আমরা গরুরা শ্রেষ্ঠ ছিলাম, আছি, থাকবো। আমরা স্বেচ্ছায় মানুষের কাছে আসিনি। মানুষই পাহাড়, বন, সমতল থেকে ধরে এনে গরু সম্প্রদায়ের অনেককে ঘরে রেখেছে।
আমরা অশ্রেষ্ঠ নই। আমরা গরুরা কি মানুষের গু (গোবর) ফেলি? গরুসভায় আগত গরুরা এক যোগে চিৎকার দিয়ে বললো, না, না! আমরা মানুষের গু (গোবর) পরিস্কার করি না। মানুষই, গরুদের গু (গোবর) পরিস্কার করে। গরুদের নেতা আবার বললেন, আমরা মানুষকে গোসল করাই না। মানুষই আমাদের গোসল করায়। আমরা গরুরা মানুষের জন্য ঘর দুয়ার বানাই না। পরিস্কার ও করি না। বরং মানুষই আমাদের জন্য গোয়াল ঘর বানায়। আমরা সেই ঘরে হাগি মুতি। আর মানুষ সেই ঘর ও আমাদের গরুর গু মুত পরিস্কার করে। অবশ্যই আমরা মানুষদের থেকে শ্রেষ্ঠ।
এমন কি আমরা মানুষের দয়া ও দুধের উপরও নির্ভরশীল নই। উল্টোটাই সত্য। মানুষই গরুর দুধ ও দয়ার উপর নির্ভরশীল। গরু না থাকলে না পাবে দুধ, না চলবে হালচাষ। হাততালিতে পুরো গরুসভা তাদের নেতার ভাষনকে স্বাগত জানাচ্ছে। গরুদের নেতা বন্য গরুদের বনে ফিরে যেতে বললো। গৃহপালিত গরুদের গৃহে। কানায় কানায় পুর্ন গরুসভায় গরুদের নেতা কথা দিলেন, তিনি আজই মানুষের নেতাদের সাথে আলোচনায় বসবেন। এখন থেকে স্কুলগুলোতে গরুর অবমাননা বন্ধ করতে হবে।
মানুষের বাচ্চাকে যেন গরু বলে না পেটানো হয়। এতে গরু সমাজের,গরুনানূভূতি মারাত্মক ভাবে আহত হচ্ছে। তা বন্ধ করতে যা যা করতে হয়, গরুনেতারা তা করবেন। ১০১ বার হাম্বাধ্বনী দিয়ে গরুসভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। অতপর সবুজ দূর্বা ঘাস হরেক রকম খড়ের সাথে ব্রাজিল ও কিউবার গুড়ের নালি মিশিয়ে গরুদের খাবার পরিবেশন করা হয়। ছোট বেলায় নানার বাড়ি গিয়ে গল্প শুনতাম। নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম গল্পের মধ্যে। পঞ্চাশের কাছাকাছি এসে আবার সেই অনুভূতি ফিরে পেলাম জামালি স্যারের গল্পে। আজকের শিক্ষকেরা, গল্প বলে না। শেখায় না। কেবল পড়ায়।

এই ক্যাটাগরির আরো ব্লগপোস্ট পড়তে এখানে ক্লিক করুন…..