সাদা রঙের টয়োটা গাড়ী থেকে নামলেন দিলরুভা খালা। গাঁয়ের লোকজন তাকে এবং তার গাড়ীকে ছুঁয়ে দেখছে। কিশোর কিশেরীরা বলাবলি করছে। দ্যাখ দ্যাখ খালার টয়টা গাড়ী কত সুন্দর। কেউ কেউ টয়টাকে পয়টা বলতেছে। কারন,পয়টা এ গাঁয়ে পরিচিত শব্দ, টয়োটা নয়। তারা টয়োটা গাড়ী সাদাকালো টিভিতে দেখে। তাদের বাপ চাচারা সিনেমাতে দেখে। শাবানা ববিতা, রোজিনা, অলিভিয়া আলমগীর, ওয়াসিম, জসিম, সোহেল রানা টয়টা গাড়ীতে চড়ার গল্প শোনায়। আজ চোখের সামনে দেখছে। পয়টা দেখেছে তাদের চাচা, জ্যাঠার পায়ে।

আজকাল অবশ্য পয়টা কি তা বুঝানো কঠিন ৷ যারা দেখেনি, তাদের পাক্কা ৫ মিনিট লাগবে বুঝাতে, যে পয়টা যে পায়ের জুতার মত ব্যাবহার করে। হয়তো পয়টা শব্দটিই তারা শুনেনি। পয়টা গরীবেরা খালি পায়েই চলা ফেরা করতো বেশি তবে পয়টাও ব্যবহার করতো। খড়ম, ব্যবহার করতো ধনীরা। দিলরুভা খালা তার বাবার ব্যাবহৃত খড়ম ও পয়টা আজো রেখে দিয়েছেন। খড়ম কি তা ও আজকের কিশোর কিশোরী, তরুন তরুনীরা জানে না। খুব সুন্দরী তিনি। নইলে গ্রামের এক বিধবা তরুনী দিলরুভাকে। শহুরে ধনী ব্যাবসায়ী কেন বিয়ে করবে?
তার বিধবা হওয়ার কাহিনীগুলো আরেক সময় শোনা যাবে। তিনি ঢাকার গুলশানে থাকেন। প্রায় ৬ বছর পর তিনি গ্রামের বাড়ি এসেছেন। এ বাড়ির সকলে তো খুশি কারন দিলরুভা আধা যুগ পর গাঁয়ে এসেছে। সেই সাথে গ্রামের লোকজন। কারনটা এখন শুনলে আপনাদের হাসি আসতে পারে কিন্তু ঘটনা সত্য। এ থানায় প্রায় ১৭০টি গ্রাম আছে। পুরো থানায় দুইটির রঙ্গিন টিভি আছে কি না সন্দেহ। তাও হয়তো কেউ একমাস আগে কিনেছে। দিলরুভা খালার বাবা ঢাকায় রঙীন টিভি কিনতে গিয়েছিলেন। তার ধনী মেয়ের জামাই কিনতে দেয়নি৷ একটি রঙিন টিভিই তো৷ তার মেয়ের জামাইয়ের বেসুমার পয়সা আছে। ঢাকাইয়া জামাই বলে কথা। দিলরুভা খালা তার বাবার কথায় একটি রঙিন টিভি এনেছেন।
এখন থেকে এ গাঁয়ের লোকজন রঙিন টিভি দেখতে পারবে। এ খবর আগেই রটে গিয়েছিলো। দিলরুভা খালার মায়ের বিয়ে হলে। পালকিতে চড়ে শ্বশুড় বাড়ী এসেছিলেন। অবশ্য নৌকাতেও চড়তে হয়েছে। তারপর গরুর গাড়ীতে। দিলরুভা খালার মাকে নিজামও গরুর গাড়ীতে চড়ে বাপের বাড়ি যেতে দেখেছে।
নিজাম নিজেও দিলরুভা খালার মায়ের ও দিলরুভা খালার কোলো উঠে তার নানার বাড়ি গিয়েছিলাম কয়েকবার। আজ দিলরুভা খালা তার শ্বশুর বাড়ি ঢাকা থেকে প্রাইভেট কারে এসেছেন। তাও গাড়ীটা তার নামে কেনা। একটা নয় দুটি গাড়ী। একটা তিনি ছাড়া কারো ব্যবহার করার অনুমতি নেই। আরেকটা পরিবারের সাবাই ব্যবহার করে। পরিবার বলতে তার দেবর,নিজের দুই ছেলে। এবং সতীনের দুই কন্যা,স্বামী ও স্বাশুড়ী। সতীন বয়স্ক এ বাড়ীতে থাকে না৷ তার বাড়ি আলাদা। কেন সতীনের বাড়ী থাকেন না। তা দিলরুভা খালার জবানে এক সময় শোনা যাবে। ননদেরা মাঝে মাঝে অনুরোধ করে দিলরুভা খালার কাছ থেকে গাড়ী নিয়ে যায়।
নোনাসেরা নেয় না তাদের নিজেদেরই গাড়ী আছে। এ ছাড়া দিলরুভা খালার সাথে তার নোনাসের এর সম্পর্ক ভালো না। দিলরুভা খালার নোনাস আয়েশা মানে দিলরুভা খালার স্বামী হাজী আসলাম বেগ এর বড় বোন। নোনাস আয়েশার ধরনা। তার ভাই আসলাম বউয়ের কথায় উঠে, বসে। তাই এত রাগ দিলরুভা খালার উপর। যদিও আয়েশা তার নিজের শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কাছে একই অভিযোগে অভিযুক্ত। মানে আয়েশার স্বামীও, আয়েশার কথায় উঠে বসে। দুই ইদ ছাড়া তারা খুব কম মুখোমুখি হয়৷ হলেও কথা হয় কদাচিৎ! কথা বলা বন্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারন আছে। একবার আয়েশা বাপের বাড়ি এসেছিলো। তার ননদকে নিয়ে, আয়েশার ননদ বলেছিলো,আপনার ভাই দেখি তার বউয়ের পেটিকোট, শাড়ী ধূয়ে দেয়।
আয়েশা বিষয়টাকে তখন হেসে উড়িয়ে দিয়ে ছিলো। কিন্তু তার বুকে বিরাট ধাক্কা লাগে। তিনি, এ নিয়ে তার ভাই বউ,দিলরুভার সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দেন। এবং খুব বিশ্রী ভাষায় বকাবকি করেই খান্ত হন না। চুলোচুলিও বাধে। কিন্তু দিলরুভা খালা তো গায়ের মানুষ, আদরের দুলালি হলেও,পরিশ্রমী ছিলেন। বৃষ্টি এলে, ধান গমের বস্তা তাকেও কাঁকে,কাঁধে মাথায় নিতে হতো। আর না হয়, বস্তা, ধান,গমের ঝাঁকি, গম, সরিষা, পাটের বোঝা কাজের মানুষদের মাথায় তুলে দিতে হতো। এ ছাড়া গাছে চড়তেন, সাঁতার কাঁটতেন। গোল্লাছুট খেলতেন। ঢেঁকিতে ধান বানতেন শখ করে হলেও। যা তার শরীরকে অন্য শহুরে নারী থেকে আলাদা করে গড়ে তুলেছিলো। তা ছাড়া তিনি দীর্ঘাকায়। তাই, নোনাস আয়শা ও তার ননদ মিলে, দিলরুভা খালাকে পরাস্ত করতে পারেননি।
উল্টো তাদের দুজনকেই চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকে বাইরে বের করে দেন। সেই থেকে কথা একেবারেই বন্ধ ছিলো বেশ কয়েক বছর। আয়েশার বয়ান মতে, তার ভাই বউ দিলরুভা, তার ভাইকে কালা জাদু করে বিয়ে করেছে। আসলে ঘটনা তা নয়। দিলরুভা খালার স্বামী হাজী আসলাম বেগ দিলরুভার রুপ যৌবন দেখে প্রথম দিন থেকেই উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলো। যদিও তিনি বিবাহিত ছিলেন। এবং দুইকন্যার জনক আসলাম বেগ। মিরপুরে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে দিলরুভা খালাকে দেখে অনেকেই দিওয়ানা হয়ে গিয়ে ছিলো আসলাম বেগের মত। ভারতবর্ষের মোঘল সম্রাট শাহজাহান প্রজার রক্তচোষা পয়সায় তাজমহল বানিয়ে ছিলো।
কিন্তু দিলরুভা খালাকে নিজের রক্ত পানি করা পয়সায় গড়া গুলশানের ছয়তলা বাড়ি লিখে দিয়ে তারপর হাঙ্গা করে ছিলেন। হাঙ্গা গালি নয়, এ গাঁয়ে দ্বিতীয় কারো দ্বিতীয় বিয়েকে হাঙ্গা বলে। সে হিসেবে দুজনেরই এটা হাঙ্গা! কারন,দিলরুভা খালার স্বামী ছিলো তবে তিনি বিধবা ছিলেন। কম বয়সে বিধবা বলে তাই কেউ বুঝতে পারে না। আার দিলরুভা খালার ২য় স্বামী আসলাম বেগেরও স্ত্রী ছিলো। ১৮০ বছর আগে প্রথম রঙ্গিন টিভির ধারনা মানুষের মগজে আসে। তা আজ বাংলাদেশের মোহম্মদপুর গ্রামে আসতেছে রঙ্গিন টেলিভিশন দিলরুভা খালার কল্যানে। দিলরুভা খালাও এ অঞ্চলের অভিজাত পরিবারের। তবে তাদের বাড়িতে দুইটা,সাদা কালো টেলিভিশন আছে৷ এক খাদা জায়গা নিয়ে মানে ১৬ বিঘা জমির উপর একটা বাড়ী। একটা টিভি বাড়ির ভিতরে। যা কেবল পরিবারের লোকজনই দেখে। আরেকটা বাড়ির বাইরে গাঁয়ের লোকজনদের জন্য।
বাংলাদেশে রঙিন টিভি আমাদনি হয়েছে মাত্র কয়েক মাস হলো! এর মধ্যে একটি অজোপাড়া গায়ে চলে এলো রঙিন টেলিভিশন। শুধু রঙ্গিন টেলিভিশনটা দেখতেই শ দুয়েক গ্রামবাসী উপস্থিত হয়েছে। আগেই সাদা কালো টেলিভিশনে টারজান সিরিজ দেখতে। কয়েকশত মানুষ সন্ধ্যায় ভির করতো তাদের বাড়ির বাইরের বড় উঠোনে। যা স্থানীয়দের কাছে বাড়ির বাইরের বড় উঠোন বাইড্যাগ বলে পরিচিত। বাইড্যাগ, ধান কাটার মৌসুমে ধান মাড়াইয়ের কাজের ব্যবহার হতো। বাইড্যাগে গায়ের বিচার আচার, শালিস বসতো মাঝে মাঝে৷ বছরে দু-চারবার গানের আসরও হতো৷ কারেন্ট ছিলো না তখন। ব্যাটারির শক্তিতে চলতো টেলিভিশন! দিলরুভা খালার বাবার প্রভাবে এ গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ এসেছে অনেক আগেই।
দিলরুভা খালা একজন লোক পাঠিয়েছেন যার নাম হুরমুজ। হুরমুজ আলী দিলরুভা খালাদের বাড়িতে কাজ করে। বয়সে দিলরুভা খালার চেয়েও আট বছর বেশি। অভাবের তাড়ানায় হুরমুজ আলীর মা, দিলরুভা খালার বাবা হাজী আব্দুর রশীদ শিকদারের কাছে হুরমুজকে বিক্রি করে দিয়েছিলো। ১১০ টাকায়! তখন, পাকিস্তান আমল। ষাট সত্তুর টাকাতে এমন শিশু বিক্রি হতো। ফ্রিতেও পাওয়া যেতো কখনো কখনো। কারন, সারা দেশের গ্রামাঞ্চল গুলোতে ছিলো প্রচন্ড অভাব। হুরমুজ আলী দেখতে শুনতে ভালো ছিলো তাই হয়তো দাম একটু বেশি। সাধের ইসলামি পাকিস্তানের একজন শিশুর মূল্য ১১০ টাকা! দিলরুভা খালার বাবা হাজী আব্দুর রশীদ শিকদার , গুনে গুনে ১ টাকার ১শ টি কাগজের নোট দিয়েছিলেন।
আর দশ টাকার খুরো পয়সা দিয়ে ছিলেন,তামার! তখন, সীসা ও তামার পয়সা হতো। পা়ঁচ টাকা ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, পাঁচ টাকা তার পুত্রের জন্য জমা রাখে বড় হলে যেন তার ছেলেকে দেয়। দিলরুভা খালার বাবা রশীদ হাজী, বলেছিলেন, তোর, ৫ টাকা দিতে হবে না। তোর ছেলে বড় হলে, জমিজমা তো লিখে দিবোই। তখন গাঁয়ের মন্ডলদের একটা প্রথা ছিলো। কাউকে বাড়িতে জায়গা,দিলে বা কোন শিশুর দায়িত্ব নিলে তাকে জমিজমা লিখে দিতো।
তবুও হুরমুজ আলীর মায়ে জোর করে ৫ টাকা রেখে যেতে চায়। তখন, হাজী সাহেব বলেন, তাহলে, ৫ টাকার খুচরা রেখে যা। কাগজের টাকা তো ছিঁড়ে যাবে! হুরমুজ আলীর মা, বলে হাজী সাব,আসলেই আমার পোলারে জমি লেইখ্যা দিবেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ,লিখে দিবো। আর, এই ৫ টাকাও দিয়ে দেবো। হুরমুজ আলীর মা বুলি বেগমের চোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে, খুশিতে। কারন, এই আকালের সময় তার শিশুটা দু বেলা খেতে পারবে! তার উপর পাবে জমি!
আবার মনে মনে ভাবে, এই হাজী সাবের বাপ তো অনেক মানুষের জমি লিখে নিয়েছিলো গলায় পারা দিয়ে! সে পথে পথে ভিক্ষে করার সময় লোকমুখে এসব শুনেছে! সত্য মিথ্যা যাচাই করার সুযোগ হয়নি তার। আসলে দিলরুভা খালার দাদা ছিলেন ডাকাত। ময়মসিংহের, গফরগাঁওয়ে তার বেশ কজন ডাকাত বন্ধু ছিলো। দিলরুভা দাদা একবার গঁফরগাওয়ে দু বছর পালিয়ে ছিলেন বৃটিশ পুলিশের ডরে। দিলরুভা খালার দাদা গফরগাঁও তখন একটি বিয়ে করে ছিলেন। থানা কোর্ট কাচারি শেষ হলে, সেই স্ত্রী নিয়ে বাড়ী কিষ্টপুর নিয়ে এসেছিলেন।
দিলরুভা খালা তার সেই সৎ দাাদীকে ডাকাইত দাদী বলে ডাকতো। দাদাকে ডাকাইত না বলে, দাদীকে কেন ডাকাইত ডাকতো সে গল্প বেশ মজার। অন্য দিন বলবো। হুরমুজ আলী একটা পুরাতন সাইকেল চালায়৷ সাইকেলটা শিকদার হাজীর। হাজীর কামলা, খাস কামলা এই হরমুজ আলী। খুব বিশ্বস্ত। দিলরুভা খালার বাবা পরিচিতি আছে কয়েক নামে। শিকদার হাজি, রশীদ হাজী, হাজী আব্দুর রশীদ শিকদার। বেশি বয়স্ক লোকেরা সামনে নয়, পেছনে ডাকাইতের পোলা বলেও ডাকে।
সাইকেলে তুলে নিজামকে নিয়ে যাবে দিলরুভা খালাদের বাড়ি। সেই নির্দেশ দিয়েছেন দিলরুভা খালা। নিজাম তার সেই সাইকেলে চরে মোহাম্মদপুর যাবে। নিজামের আব্বার দোকানে গিয়ে হুরমুজ আলী বলে, ভাইজান, দিলরুভা আপনার পোলা নিজামকে নিয়ে যেতে বলেছে,নিয়ে গেলাম। নিজাম দিলরুভা খালার আপন বোনের মেয়ে নয়। নিজের বোনের ছেলের মতই মনে করে। কারন, একই গাঁয়ের মেয়ে দিলরুভা খালা ও নিজামের মা। নিজামের মায়ের চেয়ে বার, তের বছরের ছোট দিলরুভা। নিজামের বাবা সাধারনত নিজামকে, নিজামের নানার বাড়ী আর দিলরুভা খালাদের বাড়ি ছাড়া। কারো বাড়িতে রাত যাপন করার অনুমতি দেয় না। একমাত্র পুত্র বলে কথা। কেবল, পুত্র নয়। একবার নিজাম ও তার ছোট বোন তার মেজো জ্যাঠার নতুন বাড়িতে ঘুমিয়ে পরে ছিলো। ঘুমের ভিতরেই তাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো তার বাবা মা মিলে।
একবার নিজাম তার মায়ের কোল থেকেই চিৎকার কারে উঠে ছিলো ভয়ে। ভেবে ছিলো বোরকা পরা কেউ তাকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। কেননা তখন, ছেলে ধরা গল্প বাজারে ছিলো মুখে মুখে। এমনও শুনেছে ক্যাঙ্গারু রাতে এসে বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যায়! যদিও ক্যাঙ্গারু পুরো বাংলাদেশে একটাও নেই। কোন কালেই ছিলো না। নিজাম চিৎকার করে উঠলে তার মা বলে ছিলেন, নিজাম, বাবা তুমি ঘুমাও,আমি তোমার আম্মা! নিজামের মা দিনের বেলায় তো দুরের কথা রাতেও বোরকা পরে চলতেন! কারন দুটো। এক তিনি গ্রামের মুসলিম পরিবারের কন্যা। দ্বিতীয়ত নিজামের মা নুরজাহান ছিলেন সুন্দরী। তখন গ্রামের বয়স্কা ও বিবাহিতা নারী ছাড়া খুব একটা বোরকার প্রচলন ছিলো না। বিবাহিতরা ঘোমটা দিয়ে চলেই হতো৷ আর তরুনীরা মুরুব্বি দেখলে মাথায় ওড়লা দিলেন চলতো। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ বোরকা পরতো না।
নিজাম তখন ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠেছে। নিজামকে মাদরসায় দেয়ার কথা, কিন্তু দুজন শিক্ষক, একজন মুসলিম লীগ নেতা এবং দিলরুভা খলার চাপে নিজামকে আর মাদরাসায় পড়তে দেয়া হয়নি। কি বাঁচা যে বেঁচে গেছি সে। মাঝে মাঝে তা গল্প করে বন্ধুদের শোনায়।
নিজাম খুশিতেই খাইনি, কারন আজ সে রঙ্গিন টিভি দেখবে! জীবনে প্রথম রঙ্গিন টিভি দেখা হবে আজ। এ আনন্দে নিজামের পেটে ক্ষুধা নেই! নিজামের আব্বা আব্দুল করিম শেখ, হরমুজ আলীকে রসগোল্লা আর পাওরুটি খেতে দিয়েছেন। হরমুজ আলী নিজামদের বাড়ি এলে, সাধারনত ভাত খায় না। নিজামদের বাড়ি এলে, হরমুজ নিজামের মাকে বলতো, বুবু (বোন), ভাত খেয়ে এসেছি। এখন খাবো না। বলে, নিজামের আব্বার সাথে দেখা করতে বাজারের দোকানে যেতো৷ নিজামের আব্বাও জানতেন, শিকদার হাজীর বাড়িতে তো ভাতের অভাব নেই। সে ইচ্ছে করেও নিজামদের ঘরে ভাত খেতো না৷ যাতে টাউনে দোকানে গেলে তাকে রসগোল্লা আর পাউরুটি খেতে দেয়া হয়। টাউন থেকে গাঁয়ে ফিরে গেলে।
দিলরুভা খালার বাবা হাজী রশীদও তাকে জিজ্ঞেস করতেন। কি রে হুরমুজ আলী, আজ তো টাউনে গিয়েছিলি। কয়টা পাউরুটি আর রসগোল্লা খেয়েছিস? সে বলতো, আপনাদের জামাই, ছয়টা রসগোল্লা আর দুইটা বড় বড় পাউরুটি দিয়েছিলো। আর এক বাটি রস গোল্লার সুরা! দিলরুভা খালার বাবা নিজামের বাবাকে জামাই বলে ডাকতেন। কারন,নিজামের মা ও দিলরুভা খলা একই গাঁয়ের মেয়ে বলে কথা। এ গাঁয়ের পূর্বনাম ছিলো কৃষ্ণপুর, হিন্দুরা কেষ্টপুরও বলতো।
মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকেরা কিষ্টপুরও বলতো। পূর্ব বঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম লীগ নেতারা এ গায়ের নাম বদল করে রেখেছে মোহাম্মদপুর। গাঁয়ের মসজিদের মুন্সি বলে ছিলো। এ গাঁয়ের নাম না পাল্টালে ইমান থাকবে না। মাটির একটা হক আছে। মাটির হক আদায় করতে এ গাঁয়ের নাম বদলানো ফরজ। প্রথমে নাম রাখতে চেয়ে ছিলো ইসলামপুর। কিন্তু চার পাঁচ গ্রামের পরেই আরেক এলাকা, তার নাম ছিলো রামপুর। তা বদল করে ইসলাম পুর রাখা হয়ে গেছে। বাধ্য হয়েই কিস্টপুরকে, মোহাম্মদপুর নাম রাখতে হয়েছে ।
এখনো যারা বয়স্ক তারা ইসলামপুরকে রামপুর,মোহাম্মদপুরকে কিষ্টপুর বলে। কেউ কেউ ‘র’ অক্ষরটি উচ্চারন করতে না পেরে রানপুরকে, আমপুর বলে। নিজামের বড় মামাতো বোন বানেছা এবং দিলরুভা খালার খালাতো বোন পারভিন আজো রামছাগলকে, আম ছাগল বলে। দিলরুভা খলাার বাবা ঘোড়ায়,চড়ে টাউনে এলে। নিজামদের বাড়ি আসতেন সবার আগে। নিজামের নানাকে বলতেন, শুনো আজম মন্ডল। খুব ভালো করেছ, মেয়েটাকে টাউনে বিয়ে দিয়ে। তোমার জামাইটার জমি জমা কম তাতে কি? তোমার মেয়ে খুব সুখে আছে।
আমি খাদায় খাদায় জমিওয়ালা জামাই থাকলেই কারো মেয়ের এত সুখ দেখি নাই। সুখ আলাদা জিনিস। নিজামের নানা আজম মন্ডল বলতেন, হ্যাঁ, ভাই, নিজের গুষ্ঠি ও পোলারদের মতে বিরুদ্ধে, মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছি। জমি জমা ছাড়া ব্যবসায়ী জামাইয়ের কাছে। কত জনে, সামনে পিছনে কত কথা বলছে। আমার ছোট ভাই তো রাগ করে মেয়েটার বিয়ের আগের দিন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। আমার কথার উপর কথা বলতে পারে নাই।নওর ভাবিকে বলেছিলো, বড় ভাই, আমার ভাতিজির কপালটা পুরলো নিজের হাতে। আমার ছোট ভাই তো,আপনার কথায় ছয় মাস পর মেয়ের জামাই বাড়ি গিয়ে ছিলো। ফিরে এসে আমাকে বলেছিলো, বড় ভাই আমাদের নুরজাহান খুব সুখে আছে। জামাইয়ের জমি নাই বলে, ছয় বিঘা জমি নুরজাহানরে লিখে দিয়ে ছিলো।
অথচ, আমার এই ছোট ভাই আপনাকে দিয়ে শালিশ করিয়ে আমার কাছ থেকে। আট বিঘা জমি বেশি নিয়ে ছিলো। তাই না হাজী সাব? আপনি বলেছিলেন, তোমারই তো ছোট ভাইই। জেদ ধরেছে যখন, তখন খালের পার থেকে দিয়ে দাও। আমি আপনার কথা ফেলে দিতে পারিনি। জানি না, আমার মেয়ে নুরজাহানের এই সুখ কত দিন টিকবে। আল্লার কাছে দুয়া করবেন ভাই।
হাজী আবদুর রশীদ কেবল সিগারেট কেনার জন্য সপ্তাহে একদিন ঘোড়ায় চড়ে টাউনে আসেন।…..
চলবে..
পরবর্তী পার্ট পরতে এখানে ক্লিক করুন…