বিশ্ব বরেণ্য নির্বাসিত বাঙালি লেখিকা তসলিমা নাসরিন। দুু:খ করে লিখে ছিলেন,”নারীর কোন দেশ নেই!”আর তিরিশ দশকের হিন্দি সাহিত্যিক মাখন লাল চতুর্বেদী। তিনিও মনোবেদনায় লিখেছিলেন,”লেখক এক মার ডাল নে কা চিজ হ্যায়!”মানে হলো,লেখক একটি মেরে ফেলার জিনিস!তিনি তার একটি প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। খুনি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা তথা অপরাধীরা সমাজে লুকিয়ে তার সব কাজ করতে পারে। তাকে সহযোগিতা করার জন্য পরিবার সমাজ,ব্যাক্তি এমনকি রাষ্ট্রও তৈরী থাকে। একজন লেখকের বেলায় সে রকম সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ নেই।

আর,আমি বলি বাংলাদেশ,পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সংখ্যালঘু হয়ে জন্ম নেয়া অভিশাপ। বাংলাদেশের নাস্তিকদের অবস্থা দেশের সংখ্যালঘুদের চেয়েও করুন। মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসা মুক্তচিন্তক ও নাস্তিকদের জন্য বাংলাদেশ সাক্ষাৎ একটা মৃত্যুকূপ। বাংলাদেশের নাস্তিকদের দেশ তো দুরের কথা তাদের ঘরও নেই!যা বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত দেশগুলোর মানুষ বুঝবে না। যদি এই তিন দেশের কোন সংখ্যাগুরু মুসলমান কেউ আমার এ কথার সাথে দ্বিমত করেন। আমি তাকে প্রথমে সোজা বলবো,আপনি মিথ্যুক ও বদমাইশ।
এখনে আমি,নারী,লেখক ও সংখ্যালঘুদের বিষয়ে কথা বলতে চাইছি না। আমি এখন আপনাদের বাংলাদেশের মুক্তচিন্তক ও নাস্তিকদের পরিস্থিতির কথা শোনাবো। যারা সংখ্যালঘুদের চাইতেও,বেশি সংখ্যালঘু! কোন সংখ্যালঘু বা অমুসলিম নয়। বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা নাস্তিক ও মুক্তচিন্তকদের গল্প শোনাবো৷ এ গল্পগুলো কিন্তু আষাঢ়ে গল্প নয়। বাস্তব এবং সত্য।
বাংলাদেশের প্রথম স্বঘোষিত নাস্তিক হলেন,অধ্যপক ডক্টর আহমদ শরীফ। তারপর অধ্যাপক ডক্টর হুমায়ুন আজাদ। নাস্তিক আরো অনেকে ছিলেন,তারা প্রকাশ্য স্বীকার করেননি বা,স্বীকার করতে সাহস পাননি৷ যখন মুসলিম মৌলবাদীারা আজকের মত এত মহা শক্তিশালী ছিলো না। বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ নামের একটি সংগঠন তখন নিয়মিত লেখা প্রকাশ করতো৷ ঢাকার,শাহবাগের,আজীজ সুপার মার্কেটে তখন মুক্তচিন্তকদের সরব উপস্থিত ছিলো। তাদের আড্ডা,আলোচনা,লেখা সারা দেশে ছড়িয়ে পরতো। তারা রাজধানীতে থাকলেও,বরিশালের এক অজোপাড়া গাঁয়ে একজন চারণ দার্শনিকের উদয় ঘটে। তার নাম আরজ আলী মাতুব্বর। ক্লাস টু পাশ বলে শুনেছি। তাও আবার নাতীর বয়সী ছেলে মেয়েদের পাশে বসে টু পাশ করেছিলেন!


তিনি একজন বিচিত্র মানুষ ছিলেন। মৌলভীরা তার মায়ের জানাজা তথা শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বাধা দিয়ে ছিলো। কারন,তিনি একটি ছবি তুলতে চেয়ে ছিলেন তার মায়ের! একটি মৃত মানুষের ছবি তুললে নাকি ইসলাম খতরে মে চলে যায়! তথা ইসলাম ধর্ম বিপদে পরে! অথচ,আজ মৌলবিরা কেবল ছবি তুলে না। ভিডিও না করলে তাদের দিন কাটে না। আমার স্পস্ট মনে আছে আমি তখন কিশোর। একটি বিয়েতে নিমন্ত্রনে গিয়ে ছিলাম। সেখানে বিয়ের অনুষ্ঠানটি ভিডিও ধারন করার সময়। কেউ কেউ এই বলে বাধা দিয়ে ছিলো। ভিডিও করা অনৈসলামিক! আমি যখন আরো ছোট ছিলাম,তখন অজোপাড়া গায়ে বয়স্ক মৌলবিদের মুখে শুনতাম,মাইকে আজান দেয় শয়তানে! অথচ,আজ মাইকে আজান না দিতে দিলে। ঝগড়া বিবাদ মিছিল মিটিং শুরু করে দেয় মুসলিম সম্প্রদায়।
এ ঘটনাগুলো তুলে ধরছি,অতীত ও বর্তমানের তুলনা করার জন্য। আরজ আলী মাতাব্বর কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। যা আলোড়ন সৃষ্টি করে নব্বই দশকে। এবং মুক্তচিন্তকদের চিন্তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কোন অধ্যাপকের লেখা সে সময়ে তরুন সমাজের চিন্তার জগৎকে এত নড়া দিতে পারেনি৷ আগেই বলেছি, আরজ আলী মাতুব্বর টু পাশ এবং অজোপাড়া গাঁয়ে বাস করতেন! লেখক কবি ঔপনিবেশিক আহমদ ছফা লিখেছেন, তিনি মুক্ত চিন্তা চর্চার কারনে নিজের গ্রামে যেতে পারতেন না! কবি দাউদ হায়দারকে দেশ ছাড়তে হয়ে ছিলো একটি কবিতা লেখার দায়ে!
অথচ,তখন বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সরকার এবং মৌলবাদীরা এত শক্তিশালী ছিলো না! বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী তখন তৌহিদী জনতার মুখোশের আড়ালে। দাউদ হায়দারের কবিতাকে ঘিরে সারা দেশে মিছিল শুরু করে৷ ৭১ এর সেই মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা আজো একই কায়দায় “তৌহিদী জনতা”র মুখোশ পরে মাঠে নামে। মুক্তচিন্তক,সংখ্যালঘু ও নাস্তিকদের ভীতি প্রদর্শন,নিপীড়ন ও হত্যা করার জন্য। সত্তুর,আশি,নব্বই দশকের “তৌহিদী জনতা”চেয়ে। আজকের মুসলিম তৌহিদী জনতা শত ভাগ বেশি উগ্র,মূর্খ,এবং সাম্প্রদায়িক। আগে এই তৌহিদী জনতার মিছিলে কেবল মৌলেভি ও তাদের মাদরাসার ছাত্ররা থাকতো। এখন যুক্ত হয়েছে স্কুল কলেজ এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা! এই ছাত্ররা মৌলোভী,ও মাদরাসার ছাত্র থেকে বেশি যুক্তিহীন,মুর্খ,সাম্প্রদায়িক এবং উগ্র হয়।
কবি দাউদ হায়দারকে স্পেশাল বিমানে উঠিয়ে নির্বাসনে পাঠানো হয়ে ছিলো৷ অথচ, তার পরিবারের প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তি ছিলেন। এবং তৎকালীন সরকারের সাথেও দাউদ হায়দার ও তার পরিবারের সম্পর্কও ছিলো ঘনিষ্ঠ। তবুও সেই সময় তিনি দেশে থাকতে পারেননি। তাহলে আমরা যারা সাধারন তারা কিভাবে দেশে থাকতে পারবো! কবিতায় একটি পংক্তি লেখার কারনে দাউদ হায়দারকে দেশ ছাড়তে হয়েছিলো। সেই পংক্তিতে আরো দুই ধর্ম প্রবর্তকের কথাও ছিলো। সেই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায় মিছিল করেনি তাদের ধর্ম অবমাননা হয়নি।
গত ৫০ বছরে যত ধর্ম অবমাননার মামলা হয়েছে। তার ৯৯% কেবল ইসলাম ধর্ম ও রাসুলের অবমাননা! আমরা সনাতন ধর্ম,রাম ও কৃষ্ণের অবমাননার কথা শুনি না। বৌদ্ধ ধর্ম ও বুদ্ধের অবমাননার কথা শুনি না! আমরা খৃষ্ট ধর্ম ও গডের অবমাননার কথা বাংলাদেশে শুনি না! মুসলিম সম্প্রদায় কেবল এত ধর্মানানূভূতি রোগে আক্রান্ত হয় কেন?
তারপর নির্বাসনে চলে যেতে হয় তসলিমা নাসরিনকে। তার বিরুদ্ধে কিন্তু আল্লা,মুহাম্মদ ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা যায়নি। তবুও তাকে বাংলাদেশের মৌলোভী ও মুসলিমরা দেশ ছাড়া করে ছাড়ে। তাকে কাফের মুরতাদ ফতোয়া দেয়। তিনি ‘লজ্জা ‘নামে একটি উপন্যাস লিখে ছিলেন মাত্র। সেখানে মুসলিম সংখ্যাগুরুদের দ্বারা সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নিপীড়নের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। যা তখনও সত্য,এখনো সত্য। বাংলাদেশে নিয়মিত সংখ্যালঘু নির্যাতন করা হচ্ছে। কেন তিনি উপন্যাসে তা লিখবেন এটাই তার দোষ!
তারপর ডক্টর হুময়ুন আজাদকে বই মেলায় হত্যার উদ্দেশ্য কোপানো হলো। তিনি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলেন। নিরাপত্তাহীনতার কারনে চলে গেলেন জার্মানিতে। সেখানেও তার রহস্যজনক মৃত্যু হলো! অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের কি অপরাধ ছিলো? মৌললবাদী তৌদিহি জনতার দৃষ্টিতে তিনি নাস্তিক! তার উপর মুসলিম পরিবার থেকে আসা!এটা আরো বড় অপরাধ! বাংলাদেশ নাস্তিকদের জন্য একটি মৃত্যুকূপ। তাদের দেশ তো দুর ঘরও থাকতে নেই! এর আগে ডক্টর আহমদ শরীফকে কাফের,মুরতাদ ফতোয়া দেয়া দেয়া হয়েছিলো।
তার ভাগ্য ভালো,তাকে খুন হতে হয়নি! তার মৃত্যুর পর তার লাশ মেডিকেল কলেজে দান করা হয়। তাই তার জানাজা ও শেষকৃত্য নিয়ে ঝামেলা বাধাতে পারেনি মোল্লারা। যা ডক্টর হুময়ুন আজাদের বেলায় হয়ে ছিলো তাকে ঢাকায় কবর দিতে দেয়া হয়নি!তার কথাই বা কি বলবো,মুসলিম পরিবারের ক্ষনজন্মা নারী সাহিত্যিক বেগম রোকেয়াকে বৃটিশ আমলেই তো নিজের জন্ম স্থানে কবর দিতে দেয়নি মোল্লারা!
মৌলভীরা ওয়াজের নামে ধর্ম সভার মঞ্চে আহমদ শরীফ,হুমায়ুন আজাদ,তসলিমা নাসরিনকে ভর্ৎসনা করতো,এখনো করে। আজকাল তো ইসলাম ধর্ম সভায় বেগম রোকেয়াকেও গালাগালি করা হয়। এমন কি নারী অধিকার কর্মি ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের জাহান্নামী বলতো,এখনো বলে। কেবল নাস্তিক,মুক্তচিন্তক ও লেখকদের নয়,মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের গালাগালি করার উত্তম স্থান হলো এই ওয়াজের মঞ্চ। তথা ইসলাম ধর্ম সভা। মুক্তিযুদ্ধ,বাকস্বাধীনতা,মুক্তচিন্তা,নারীর সমঅধিকার, গনতন্ত্র,সমাজতন্ত্র,সমতা,মানবাধিকার বিরোধীদের উল্লম্ফন করার স্থান হলো ইসলাম ধর্ম সভা ও ওয়াজের মঞ্চ।
এর পর ২০১২ সালের পর একে একে প্রায় দুই ডজন ব্লগার হত্যা করা হয়। অভিযোগ ব্লগারেরা নাস্তিক! স্বাধীনতা বিরোধী ও মুসলমি মৌলবাদীরা মুক্তচিন্তকদেরও নাস্তিক ঘোষনা করলো। প্রকাশ্য হত্যার হুমকি দিলো। সরকার তাদের দু এজনকে গ্রেপ্তার করলেও,রাষ্ট্রের ভূমিকাকে কেউ কেউ সন্দেহের চোখে দেখলো। যাদের সুযোগ ছিলো তারা দেশ ছেড়ে জীবন রক্ষা করলেন। যে সকল মুক্তচিন্তক ও নাস্তিক যারা বিদশে যেতে চাননি৷ বা ও পরিবার পরিজন ছেড়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে, আত্মগোপনে নিজের ও পরিবারের জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করে চলছেন৷ মানে হলো,মুক্তচিন্তক ও নাস্তিকদের বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ! অথচ প্রতিটি নাগরিকের বাকস্বাধীনতার অধিকার বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত। এবং জাতিসংঘ সনদও পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বলে। যা বাংলাদেশে পুরোপুরি উপেক্ষিত!
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিপক্ষে অন্তত কথা বলার মানুষ খুঁজে পাবেন যদিও তারা সংখ্যায় খুব কম৷ দেশি বিদেশী সংগঠনও পাবেন সংখ্যালঘুদের পক্ষে অন্তত কথা বলার জন্য। কিন্তু মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসা নাস্তিক ও মুক্তচিন্তকদের পক্ষে কথা বলার মানুষ এবং একটি সংগঠন খুঁজে পাবেন না। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা বিপদে আছে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তচিন্তক ও নাস্তিকেরা যে মহা বিপদে আছে সে খবর কেউ রাখে না! বাংলাদেশে মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসা নাস্তিক ও মুক্তচিন্তাকেরা কত বড় বিপদে আছে তার একটা উদাহারন দেউ। এ মুহুর্তে কোন ব্যাক্তি বা সংগঠন শ্রেফ মুক্তচিন্তক ও নাস্তিকদের বাকস্বাধীনতার পক্ষে বিবৃতি দিয়ে দেখুক। বিবৃতি দিলেই সেই বিবৃতি দাতা নিজেই খুন হয়ে যাবে!
আর কোন সংগঠন যদি বিবৃতি দেয়,তবে সেই সংগঠনের অফিস পুড়িয়ে দেবে “তৌহিদী জনতা’! এই তৌহিদী জনতা কারা?বাংলাদেশের সর্বস্তরের মুসলমান। বিস্ময়কর বিষয় হলো, এই তৌহিদী জনতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও সরকার কোন ব্যবস্থা নেয়নি, নিচ্ছেও না! এ মুহুর্তে মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসা একজন নাস্তিকের জীবন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ন। আগেও জীবন নাশের ঝুঁকি ছিলো৷ এখন একজন নাস্তিকের খুন হওয়ার ঝুঁকি ১শ গুন বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
তৌহিদী জনতার হাতে,মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসা একজন নাস্তিকের খুন হওয়ার ঝুঁকি তো থাকেই। এ ছাড়া বাংলাদেশে একজন নাস্তিক ও মুক্তচিন্তকের জীবন যে কত বেদনার,কত কষ্টের তা উত্তর আমেরিকা,দক্ষিণ আমেরিকা ইউরোপ এমনকি পাশের দেশ ভারতের হিন্দুরাও কল্পনা করতে পারবে না। কারন,বাংলাদেশের সমাজের পরিবারের সাম্প্রদায়িক চিন্তা। বাকস্বাধীনতা সম্পর্কে সমাজের বিরুপ ধারনা সম্পর্কেও বিশ্ববাসীর অজানা।
বাংলাদেশে যদি জেনে যায় আপনি নাস্তিক। তাহলে আপনাকে কেউ চাকরি দেবে না। এমন কি সরকারী চাকরি করলেও আপনার চাকরি চলে যাবে৷ ব্যবসা করলে বয়কট করবে আপনার সমাজ। আপনি নাস্তিক হলে কেউ আপনার কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে না। শুধু তাই নয়। আপনাকে মারতে আসবে যে কোন ছলে! আপনি আপনার সমাজে একা হয়ে যাবেন। এ তো গেলো সমাজের চাপ। আপনি নাাস্তিক হলে বা মুক্তচিন্তক হলে,নিজের আত্মীয় স্বজন আপনাকে এড়িয়ে চলবে। মুক্তচিন্তার চর্চা করলে প্রথমত আপনাকে ধর্মের সমালোচক ও নাস্তিক মনে করবে। আর আপনার সমাজের মৌলভী ও মৌলভীদের সংগঠন আপনার আত্মীয়স্বজনকে হুমকি দেবে। যা আমার বেলাতেও ঘটেছিলো। স্থানীয় ইমামদের সংগঠনের সভাপতি আমার আত্মীয় স্বজনকে বলেছিলো,আমাকে আশ্রয়,প্রশ্রয় দিলে সবার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেবে!
এ তো গেলো সমাজ ও আত্মীয় স্বজনের কথা। সব চেয়ে মারাত্মক যে বিষয়,তাহলো বাংলাদেশের মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসা একজন নাস্তিককে তার পরিবারের মুখোমুখি হতে হয়! তার পিতা, মাতা,ভাই,বোন,স্ত্রী,পুত্র,কন্যার বাধার মুখোমুখি হতে হয়! কখনো তারা সরাসরি বিরোধিতা করে। কখনো বা আত্মীয় স্বজন,প্রতিবেশী সমাজের চাপে বাধা হয়ে দাড়ায়!
আমি ঢাকায়,মুক্তচিন্তক ও নাস্তিকদের কয়েকটি আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে ছিলাম। কেউ কেউ বলেছেন,নাস্তিক হওয়ার কারনে। স্ত্রী,সন্তান তাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে! কেউ কেউ বলেছে স্বামী তাকে তালাক দিয়েছে। কেউ কেউ বলেছে,নাস্তিক হওয়ার কারনে মা বাবা পিটিয়েছে৷ কেউ কেউ বলেছে,তাদের ভাই বা বোন বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। কেউ কেউ বলেছে,চাকরি থেকে বিদায় করে দিয়েছে। যখন কর্মক্ষেত্রে তার নাস্তিক ও মুক্তচিন্তক পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেছে।
আমাকে তো এক নারী বলেছিলো,তার নাস্তিক পরিচয় প্রকাশের কারনে,তাকে তার এলকার কয়েকজন মিলে গনধর্ষন করেছিলো! ভাবা যায়? সমাজে বিচার পাওয়া তো দুরের কথা। তার পরিবার থেকেও কোন সাপোর্ট পায়নি। বরং তার পরিবার উল্টো বলেছিলো নাস্তিক হলে তো গজব পরবেই! বাংলাদেশে মুসলিম পুরুষেরাই নিজেকে নাস্তিক ঘোষনা দিয়ে টিকতে পারে না। আর তো মুসলিম নারী!
আমার এলকায় আমাকে রাতে হাত পা বেধে রেল লাইনে রেখে দেয়ার পরিকল্পনাও করা হয়ে ছিলো। অপরাধ আমি নাস্তিক। বন্ধুদের সাথে দিনের বেলায় আড্ডা দেয়ার সময় তো কয়েকবার মারতে এসেছিলো। সঙ্গে থাকা অন্য বন্ধুরা ফিরিয়ে ছিলো কয়েকবার। হঠাৎ করে দিনে ও রাতে কয়েকবার আমাকে মেরে ফেলতে এসেছিলে৷ স্থানীয় বাজারের লোকজনের সহযোগীতায় অল্পের জন্য জীবন রক্ষা হয়। আমার উপর ছয় সাত বার আক্রমন হয়। দু বাবার তো আমি টেরই পাইনি যে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছ। আশে পাশে থাকা লোকেরা বুঝতে পেরে আমাকে রক্ষা করে!
একবার স্থানীয়,মসজিদে জুম্মার দিনে। মসজিদের ইমাম বলেছিলো,যদি স্থানীয় কেউ আমাকে না হত্যা করে। তবে,ইমাম নিজেই আমাকে হত্যা করবে৷ পরিকল্পনা করে জুম্মার নামাজ শেষে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে৷ এই খবর শুনে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী এক ব্যাক্তি নামাজ বাদ দিয়ে আমার বাড়িতে চলে আসে। আমাকে ঘটনা বলে,এবং দ্রুত বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে। সে দিন আমি এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়ে দেই৷ এবং প্রায় দেড় বছর এলকায় যায়নি।
কখনো কখনো এমনও হয়েছে। আমার বোন আমাকে তার বাড়িয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো! তার সন্তানদেরও আমার সাথে চলতে দেয়নি!
অপরাধ কি ছিলে আমার? আমি ধর্ম চর্চা করি না! স্রষ্টায় বিশ্বাস করি না। আমি কাউকে গালি দেইনি। কারো সম্পদ দখল করিনি৷ দূর্নীতি করিনি। খুন করিনি৷ ধর্ষন করিনি। ড্রাগ বিক্রি করিনি। ড্রাগ গ্রহন করনি। এমন কি আমি ধূমপায়ীও নই। সমাজে,পরিবারে কারো সাথে আমার কোন ঝগড়া ফ্যাসাদ নেই। কারে ক্ষতি তো করিই নি। বরং মানুষের সমাজের অনেকের উপকার করেছি। যারা পড়া লেখা ছেড় দিয়েছিলো। তাদের উৎসাহ দিয়ে আবার পড়ালেখা করিয়েছি। নিজে তাদের প্রাইভেট পড়াতাম। কত কিশোরীর পড়া লেখা মা বাবারা বন্ধ করে দিয়েছিলো। আমি তাদের অভিভাবকদের পুনরায় বুঝিয়ে স্কুলে পাঠিয়েছি। কারো কারো অর্থ সমস্যা ছিলো যাতে তাদের পড়ালেখা বন্ধ না হয়।
সে ব্যবস্থা করেছি। কিছু মানুষকে বিন টাকায় চিকিৎসা করিয়ে দিয়েছি। আমার দ্বারা রাষ্ট্রের ও সমাজের কারো ক্ষতি হয়নি। তবুও আমাকে বেশ কয়েকবারই হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। আমি কায়দা করে বারবার বেঁচে গেছি। কারন, আমি অভিজিৎ রায় বা দীপনের মত নিরীহ বা সহজ সরল ছিলাম না৷ শহুরে ছিলাম না,গাঁয়ের মানুষ ছিলাম। দৌড়াতে পারি,সাহস আছে,শক্তি আছে শত্রুর মুখোমুখি হবার। তাছাড়া পরিস্থিতি আমাকে অনেক কিছু শেখাতো কিভাবে টিকে থাকতে হয়! অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন,আমি তাহলে কিভাবে বেঁচে আছি মৌলবাদীদের হাত থেকে? প্রথমত আমি এলাকায় খুব কম যেতাম৷ ২য়ত লোকজনেই গুজব ছড়িয়ে ছিলো আমি বিদেশে থাকি! তৃতীয়ত আমার অবস্থান কেউ নির্নয় করতে পারতো না। বেশির ভাগ সময় আমি মোবাইল সাথে রাখতাম না। এই যে অনেকে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন,”ফরিদ ফোন ধরে না।”
এটা তার একটা কারন ছিলো।আমার মোবাইল ঢাকার উত্তরে থাকলে আমি থাকতাম ঢাকার দক্ষিনে। আর আমার ভাড়া করা বাসা থাকতো দুইটা। একটা সকলে জানতো, আরেকটা কেউ জানতো না! তার উপর আবার মাঝে মাঝেই থাকতাম সেনানিবাসে। আমি এতবার সেনানিবাসে থেকেছি যে আমাকে খোদ আর্মীরাই তাদের কলিগ মনে করতো। যখনি ব্লাগার ও মুক্তচিন্তকদের উপর হামলার সম্ভবনা থাকতো৷ আমার এলকার দু জন ছাড়া কেউ আমার রাত্রী যাপনের অবস্থান জানতো না।
আমার বেশির ভাগ সময় কাটতো বই পড়ে। আমি গ্রন্থাগারগুলোতে অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছি। আমি নিদৃষ্ট মানুষ ছাড়া কারো সাথে মিশতাম না। তাছাড়া আমাকে বয়স কম দেখাতো অনেকেই বুঝতে পারতো না আমি সেই ফরিদ। যাকে মৌলভীরা হত্যার জন্য খুৃঁজে। চুলে তখন কলপ দিতাম তাতে আরো আমাকে চেনা যেতো না। বয়স কম দেখাতো।
এ ছাড়া আমি মাঝে মাঝে বৈধ ও অবৈধ পথে ভারতে গিয়ে কোলকাতা,চেন্নাই,দিল্লি হরিয়ানা,বোম্বে,ভোপাল,ঝাঁসীতে থাকতাম। আমি সকালে বাংলাদেশের জামালপুর থাকতাম তো রাতে ভারতের আজমের! রাতে ঢাকায় তো সকালে কোলকাতা! দুপুরে চেন্নাই তো রাতে চর সরিষাবাড়ি। আমাকে কখনো লাইভ ভিডিওতে কুমিল্লা দেখা গেলেও পরেরদিন ভারতীয় করমন্ডল এক্সপ্রেসে দেখা যেতো। আবার কখনো কখনো মোবাইল ব্যবহার করতামই না ! এ রকম কায়দা করে বেঁচে থাকতাম। কিন্তু ২০২৪ এর ৫ আগস্টের পর আর সে সুযোগ নেই। কারন,আমি মুক্তচিন্তক এবল একই সাথে শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের বিরুদ্ধে গনজাগরণ মঞ্চের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলাম। এবং শুরু থেকেই তথাকথিত কোটা বিরোধী আন্দোলনের কঠোর সমালোচক আমি।
জুলাই আগস্টের আন্দোলনকে মৌলবাদীদের আন্দোলন মনে করি। কারন,এ আন্দোলনে আমি মাঠে থেকে নিজের চোখে দেখেছি। কোন শ্রেনীর লোকজন এ আন্দোলনে যুক্তছিলো৷ কোটা আন্দোলন ছিলো বাহানা। দেশ বিরোধী দেশি বিদেশী শক্তি কোটা আন্দোলনের নামে দেশকে অস্থিতিশীল কর তোলাই ছিলো মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলাই অপরাধ! আপনাকে আওয়ামী লীগের সহযোগী বলে হত্যা করা হতে পারে৷ কপাল ভালো থাকলে,পিটিয়ে মামলা দিয়ে জেল হাজতে পাঠাবে ৷
সেখানে একজন মুক্তচিন্তক ও নাস্তিকের খুন হওয়া তো খুব ছোট্ট বিষয়। তসলিমা নাসরিন লিখে ছিলেন, নারীর কোন দেশ নেই! আমি বলি বাংলাদেশে নাস্তিকদের ঘরও নেই! বাংলাদেশের একটি ঘরও নাস্তিকদের জন্য নিরাপদ নয়। আজ মাখন লাল চতুর্বেদী বেঁচে থাকলে লিখতেন। নাস্তিক এক মার ডাল নে কা চিজ হ্যায়! নাস্তিক এক হত্যা করার জিনিস! বাংলাদেশের প্রত্যেক মৌলভী ও তার ছাত্র বিশ্বাস করে করে নাস্তিকদের হত্যা করা ধর্মীয় কর্তব্য!
শুধু মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকই আজকাল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক তাই মনে করে। বাংলাদেশের মুসলমানদের সন্তানদের যারা মাদরাসায় ধর্ষন করে করে মেরে ফেলে। বাংলাদেশের মুসলমানেরা তাদের শত্রু মনে করে না। বাংলাদেশের মুসলমানেরা৷ বাংলাদেশের মুসলমানেরা ইহুদি ও নাস্তিকদের শত্রু মনে করে। তারা মনে করে ইহুদি এবং বাংলাদেশের নাস্তিক খুন করতে পারলে সহজে তারা তাদের কল্পিত জান্নাত পেয়ে যাবে। যেখনে রয়েছে মদের নদী,৭২ ভার্জিন তরুনী অপেক্ষা করতে তাদের আগমনের জন্য।
বাংলাদেশের মুসলিম শিশু,কিশোর যুবক যুবতী ও বয়স্ক মুসলমানেরা বিশ্বাস করে। রবীন্দ্রনাথ,নজরুলের নোবেল চুরি করেছে! তারা একবারও রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ গ্রহনের দিনক্ষন। এবং নজরুল ইসলামের জন্ম তারিখটা তাদের সামনে থাকা বইয়ের পাতাটা উল্টে দেখে না। এরকম যুক্তিহীন মুর্খ মুসলমানদের দেশ,আজকের এই বাংলাদেশ। সেই দেশে একজন যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তক ও নাস্তিক কিভাবে থাকবে? বা বেঁচে থাকতে পারবে! এ কথা আমি ইউরোপ আমেরিকার নাগরিকদের কিভাবে বুঝাবো? যা,আমি আমাদের পাশের দেশ ভারতের বাংলাভাষি কোলকাতার বাসিন্দাদের বুঝাতে পারি নি! যে দেশে গরুর বাট থেকে সাপে দুধ খেতে পারে না,বললে ধরে পেটায়। আমাকে পিটিয়েছে এ কথা বলার জন্য! সে দেশে যুক্তিবাদী,মুক্তচিন্তক, নাস্তিক কিভাবে বেঁচে থাকবে টিকে থাকবে? আপনারাই বলুন!
যে দেশের একটা,বৃহত্তর অংশ বিশ্বাস করে ১৯৭১ মুক্তিযোদ্ধারা কাফের ছিলো! ১৯৫২ ভাষা-আন্দোলনকারীরাও ছিলো কাফের! ইসলাম ধর্ম মতে,যে ব্যাক্তি অমুসলিম সে কাফের। যে কাফের,সে ঘৃণিত এবং কাফের হত্যার যোগ্য। যে দেশের একটি বৃহৎ অংশ মনে করে,মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের লোকজনও মুসলমান নয়! খোদ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে,তার আওয়ামী লীগের কর্মিদের মসজিদে ঢুকিয়ে বলে,বল,আওয়ামী লীগ,হিন্দুর দল! ইহুদির দল! এবং মুসলিম পরিবারের হলেও তাদেরকে পুনরায় কালেমা পড়িয়ে মুসলমান বানানো হয়!
সেই দেশে একজন নাস্তিক কি জীবীত থাকতে পারবে? কখনোই না। মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসা একজন নাস্তিকের জন্য বাংলাদেশ একটি মৃত্যুকূপ! এই মৃত্যু কূপ থেকে উদ্ধার করা তো দুরের কথা। পক্ষে কথা বলারও মানুষ নেই। নেই কোন দেশি বিদেশী সংগঠন। না,আমি কোন ব্যাক্তি বা সংগঠনকে দোষ দিচ্ছি না। একজন নাস্তিকের পক্ষে তো খোদ তার পরিবারের লোকজন,আত্মীয়স্বজনই থাকে না। বাংলাদেশ এখন নাস্তিকদের জন্য একটি মৃত্যুকূপ। বাংলাদেশের নাস্তিকদের দেশ,সমাজ, পরিবার এমন কি ঘরও নেই!
বাংলাদেশে মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসা নাস্তিকদের এ বেদনার কথা,কষ্টের কথা। তাদের জীবনের ঝুঁকির কথা,পৃথিবীবাসী জানে না। বুঝেও না। এমন কি তা বিশ্ববাসীকে জানানোরও কেউ নেই। কারন,যারা বিশ্ববাসীকে জানাবে তারা সাংবাদিক। আর বাংলাদের সাংবাদিকের তো মুসলিম তাই না? এ ছাড়া যারা দু চারজন আছেন নাস্তিকদের পক্ষে কথা,বলার তাদেরও তো জীবন ও চাকরি হারানোর ডর ভয় আছে।
আরো ব্লগপোস্ট পড়তে এখানে ক্লিক করুন…..