১৬ ডিসেম্বর ২০২০, বাংলাদেশের ৫০তম বিজয় দিবস। প্রায় অর্ধশত বছর আগে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী এই দিনে আত্মসমর্পণ করে। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি ছিলেন। কোন পরাজিত সৈন্যদলকে কোন দেশ ও দেশের মানুষ স্বাগত জানায় না। পাকিস্তানিরা তাদের পরাজিত সৈন্যদের বাহিনীর স্বাগত জানিয়ে ছিলো! যা একই সাথে বিচিত্র ও হাস্যকর।
আমরা ইতিহাসে পড়েছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে সংগঠিত হয়েছিলো। তা সত্য। তবে এই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এ ইতিহাস আরো বড় সত্য। যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা অনেকে “সাধের পাকিস্তান”ও তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তাদের মোহভঙ্গ ঘটে। যখন পাকিস্তানের শাসকেরা বলে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। এই রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক একদিন মুক্তিযুদ্ধের রূপ নেয়। একদল বাঙালি কুলাঙ্গার ১৯৫২ খৃষ্টাব্দে ভাষা আন্দোলনেও বাঙালি ও বাংলা ভাষার প্রতিপক্ষ ছিল। তাদের পছন্দ ছিলো উর্দু ভাষা ও পাকিস্তানের পাঞ্জাবী শাসন!
তেমনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলো একদল বাঙালি। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী গোষ্ঠীরা বরাবরই পবিত্র ইসলাম ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলো। সেই বকধার্মিক ও মৌলবাদী পাকিস্তানের পাঞ্জাবী শাসক গোষ্ঠীর তাবেদারেরা দুবারই পরাজিত হয়েছিল। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো হলেও, কোন শ্রেনীটা ৫২ ও ৭১ বাংলা ভাষা ও বাঙালির বিরোধীতা করেছিলো এবং কোন কোন কৌশল গ্রহন করেছিলো তা পড়ায় না। পড়তে তো দেয়ই না। জানতেও দেয় না। সে আলোচনাও এক প্রকার নিষিদ্ধ!
ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের উত্তরসূরীরা একই কৌশলে, একই মুখোশে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ৮০’র দশক পর্যন্ত গোপনে, ৯০ দশকে আধা গোপনে, এখন তারা প্রকাশ্যে শেখ মুজিব, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, শহীদ মিনারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিদ্ধেষ ও বিভ্রান্তি ছড়ায়। ইতিহাস বিকৃতি ঘটায়। যারা হৃদয়ে হেফাজতে পাকিস্তান, তারা একজোট হয়ে হেফাজত শব্দের আগে পিছে অন্য শব্দ যুক্ত করে মাঠে ময়দানে বুনো ষাঁড়ের মত ঘুরে বেড়ায়। স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। বইয়ে পড়ানো হলেও। সেই স্বাধীনতা রক্ষায় রাষ্ট্র ও সমাজের ভূমিকা কতটুকু শক্তিশালী তা আমরা অনুমান করতে পারছি না।
একটি দেশের স্বাধীনতা সকল নাগরিকেরা ভোগ করবে। এটা কোন দয়া বা দানের বিষয় নয়। এটা সাংবিধানিক অধিকার। এক টিকিট কেটে একজন বিহারি সাতফুটের চার আসন নিয়ে শুয়ে শুয়ে ঢাকা টু সৈয়দপুর যাবে। আর বাঙলি সেই ট্রেনে টিকিট কেটে দাড়িয়ে থাকবে। এরকম শত অনিয়ম ভেঙ্গে ফেলার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো। আরো জানা উচিত যে, ১৯৭১ এর যুদ্ধ কেবল মুক্তিযুদ্ধ ছিল না, স্বাধীনতা সংগ্রামও ছিল। আমরা সাধারণ জনগণ কি স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করছি? করতে পারছি কি! অনেকেই মনে করেন এ দেশের স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ উপভোগ করে কেবল শাসক গোষ্ঠী। অর্থাৎ যখন যে বা যারা শাসন ক্ষমতায় থাকেন, তারা। এবং তাদের সহযোগী লুটেরা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়!
যা মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের পরিপন্থী। আর বাক্ স্বাধীনতা তো দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে আসছে। রাষ্ট্র এবং মৌলবাদী গোষ্ঠী একযোগে মানুষের বাক্ স্বাধীনতা কেরে নিতে খড়গহস্ত! অথচ বাক্ স্বাধীনতা না থাকলে স্বাধীনতাই অর্থহীন হয়ে পরে। বাক্ স্বাধীনতা বিশেষ করে মৌলবাদী গোষ্ঠীর একেবারেই না পছন্দ! যদিও তারা নিজেরা শতভাগ বাক্ স্বাধীনতা ভোগ করছে। ভোগ করছে বললে ভুল হবে। তারা গায়ের জোড়ে তাদের বাক্ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছে। যা ইচ্ছা তাই বলে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার এবং বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। সমাজ রাষ্ট্র ও বিজ্ঞানের বিষয়ে তাদের মিথ্যাচার একই সাথে কৌতুকে ভরপুর এবং ভয়ংকর। সাম্প্রায়িক সম্প্রীতি ও বিশ্ব ও মানবতার জন্য বিপদজনক। এমনকি তারা নিজেরা বহুধা বিভক্ত, নিজেদের বিরুদ্ধেও পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দেওয়ায় তাদের জুড়ি মেলা কঠিন।

মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় দিবসের সুফল সকল বাংলাদেশের সকল নাগরিক ভোগ করার সুযোগ যখন পাবে, তখন ৩০ লক্ষ মানুষের বলিদান সফল হবে। শুধু মাত্র শাসক শ্রেনী, কিছু লুটেরা ব্যবসায়ী ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর জন্য আমাদের মাতৃভূমি স্বাধীনতা অর্জন করেনি। সর্ব সাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের পূর্বসূরীরা তাদের জীবন ও সম্ভ্রম উৎসর্গ করেছেন। আমরা তাদের সেই আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দিতে পারি না। আমরা নতুন প্রজন্ম অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করবোই। বাংলাভাষা, বাংলার সংস্কৃতি, সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব, সকল নাগরিক অধিকার রক্ষার অঙ্গিকার নিয়ে আমরা এগিয়ে যাবো।
এই ক্যাটাগরির আরো ব্লগপোস্ট পড়তে এখানে ক্লিক করুন…..